সচেতন হই, সচেতন করি ব্রেস্ট ক্যান্সার মুক্ত বিশ্বগড়ি
আপনি যখন এই লেখাগুলো পড়ছেন ঠিক সেই সময়েই পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে একজন নারী ব্রেস্ট ক্যান্সার এ আক্রান্ত হচ্ছেন ।নারী দেহে গঠিত সকল ক্যান্সার এর মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার অন্যতম।
ব্রেস্ট ক্যান্সার কি?
স্তনের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে, ওই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমার বা পিণ্ডে পরিণত হয় । সেটি রক্তনালীর লসিকা ও অন্যান্য মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে । এই ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই ক্যান্সার। স্তনক্যান্সার হলে স্তনের কোষগুলি নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেড়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের স্তনক্যান্সার রয়েছে । স্তনক্যান্সার এর ধরন নির্ভর করে স্তনের কোন কোষগুলি ক্যান্সারে পরিণত হয় তার উপর । বেশিরভাগ স্তনক্যান্সার নালী বা লোবিউলে শুরু হয় ।
ব্রেস্ট ক্যান্সার কেন হয়?
বেশির ভাগ নারী নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন না । স্তনক্যান্সার এ আক্রান্ত হওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে । তবে যেসব মায়েরা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান না, তাদের স্তনক্যান্সার হওয়ার ঝুকি বেশি থাকে। প্রথমত এর জন্য দায়ী আমাদের জীবন যাত্রার আমুল পরিবর্তন । যেমন আজকাল আমরা অধিক হারে ফাস্ট ফুড খাই, সবুজ শাক সবজি খুব কম খাই, কম শারীরিক পরিশ্রম করি । যার কারনে স্থুলতায় ভুগি আর স্থুলতা স্তনক্যান্সার এর অন্যতম প্রধান কারন । এছাড়া দেরিতে সন্তান নেয়া-ও এখন এর কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে । বেশি বয়স, গড় আয়ু বেড়ে যাওয়াতে এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে ।
লক্ষণ:
১. স্তনের আকার-আকৃতির হঠাৎ অস্বাভাবিক পরিবর্তন,
২. স্তনের ত্বকের রঙ পরিবর্তন বা চামড়া লাল হয়ে যাওয়া,
৩. স্তনের ভিতরে অতিরিক্ত কোনো অংশ বা পিণ্ড অনুভব করা,
৪. স্তন হতে তরল অথবা পুঁজ মিশ্রিত তরল বের হওয়া,
৫. স্তনেঅতিরিক্ত ব্যথা অনুভব করা,
৬. স্তনবৃত্তের আশেপাশে ক্যাশ বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়া,
৭. স্তনের বোঁটা ভেতরে ঢুকে যাওয়া,
৮. স্তনের বোঁটার চামড়া কুচকে যাওয়া অথবা চামড়া ওঠে যাওয়া,
উপরোক্ত যেকোনো ধরনের লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে । পরবর্তীতে চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করতে পারবেন এটি স্তনক্যান্সার কি না ।
চিকিৎসা :
সাধারণত টিস্যু বায়োপসি করে এটি প্রাথমিক ভাবে নির্ণয় করা হয় । স্তনক্যান্সার চিকিৎসায় সবচেয়ে সাধারণ চিকিৎসা সার্জারি বা রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপির আকারে হয়।
সার্জারি : স্তনক্যান্সারের যে কোনো পর্যায়েই রোগীর সার্জারি করা প্রয়োজন হতে পারে । সার্জারি করা যাবে কিনা বা কী ধরনের সার্জারি হবে তাই প্রাথমিক বিবেচ্য বিষয় । সিদ্ধান্তনেবেন সার্জন এবং ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ দু’জনে মিলে । অনেক সময় শুধু টিউমার কেটে ফেলা হয় । অনেক সময় পুরো ব্রেস্টই ফেলে দেয়া হয় ।
কেমোথেরাপি : সার্জারির আগে বা পরে এমনকি রোগ শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়লেও কেমোথেরাপি কাজ করে। যদিও কেমোথেরাপিতে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে তবুও রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য কেমোথেরাপির বিকল্প নেই। রোগীর শারীরিক অবস্থা, কেমোথেরাপির কার্যকারিতা, রোগীর আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়েই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা উপযুক্ত পরামর্শ দেন।
রেডিওথেরাপি : বিশেষ ধরনের মেশিনের মাধ্যমে রোগীদের রেডিওথেরাপি চিকিৎসা দেয়া হয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সাধারণ কেমোথেরাপির পরই রেডিওথেরাপি দেয়া হয়। শুধু স্তনে নয়, যদি ক্যান্সার হাড়েও ছড়িয়ে পড়ে তাহলেও সেখানে রেডিও থেরাপি দিয়ে হাড়ের ভাঙন বা ফ্র্যাকচার রোধ করা যায়।
প্রতিরোধ:
১.জন্মের পর থেকেই বাচ্চাকে বুকের দুধ দেওয়,।
২.প্রতিদিন নিয়ম অনুযায়ী ব্যয়াম করা,
৩.নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস গড়ে তোলা,
৪.ধুমপানের অভ্যাস থাকলে তা বন্ধ করা ও ধুমপানরত ব্যক্তি হতে দূরে থাকা,
৫.খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়ার অভ্যাস করা,
৬.জাঙ্কফুড,চিনি,খোলা বা কাঁচা লবণ ইত্যাদি পরিহার করা,
৭.নিয়মিত তাজা শাক—সবজি,দেশীয় ফলমূল খাওয়া ও পরিমাণমতো পানি পান কর।।
বিশ্বে ব্রেস্ট ক্যান্সারের বর্তমান অবস্থা:
স্তনক্যান্সার বিশ্বব্যাপী নারীদের ক্যান্সার মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। এটি বিশ্বব্যাপী ১৮৪টি দেশের মধ্যে ১৪০টি দেশে মহিলাদের মধ্যে সর্বাধিক নির্ণয় করা ক্যান্সার। BCSR এর তথ্য অনুযায়ী ২০০৮ সাল থেকে, বিশ্বব্যাপী স্তনক্যান্সারের ঘটনা ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। মৃত্যুহার বেড়েছে ১৪ শতাংশ এরও বেশি । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্তনক্যান্সারে মৃত্যু হয় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে বেশি। সাধারণত, ৫০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের ঝুঁকি বেশি থাকে এই ক্যান্সারের । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে, বিশ্বব্যাপী ২.৩ মিলিয়ন নারী স্তনক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে এবং ৬৮৫,০০০ জন মারা গেছে। ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত, ৭.৮ মিলিয়ন মহিলা জীবিত ছিলেন যারা গত ৫ বছরে স্তনক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন, যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত ক্যান্সারে পরিণত করেছে। বয়ঃসন্ধির পর যে কোনো বয়সে মহিলাদের মধ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশে স্তনক্যান্সার দেখা দেয় কিন্তু পরবর্তী জীবনে এর হার বৃদ্ধি পায়। শুধু নারীরাই নয়, পুরুষদেরও স্তনক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে । প্রতিনিয়ত বাড়ছে স্তন ক্যান্সারের হার। তবে আশার কথা যে স্তনক্যান্সার রোগীদের ৯০%, ৫ বছর বা তার বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে যদি স্তনক্যান্সার শনাক্ত করা হয় প্রাথমিক পর্যায়ে এবং নিয়মিত সঠিক চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্রেস্ট ক্যান্সার:
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে স্তনক্যান্সার আক্রান্তে মৃত্যুর হারও। সামগ্রিকভাবে মহিলাদের মধ্যে স্তনক্যান্সার সবচেয়ে সাধারণ ক্যান্সার ।বাংলাদশে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী নারীদের মধ্যে স্তনক্যান্সারের অবস্থান দ্বিতীয় । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর স্তনক্যান্সার ১৫,০০০ জনেরও বেশি লোকের স্তনক্যান্সার নির্ণয় করা হয়েছে । এর মধ্যে ৯৮ শতাংশের বেশি নারী যদিও খুব কম পুরুষেরই স্তনক্যান্সার ধরা পড়েছে । প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ প্রতি বছর এই রোগে মারা যায়। দেখা যাচ্ছে, আক্রান্তদের অর্ধেক মারা গেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছ অচেতনতা। বাংলাদেশে প্রতি ১০০০০০ মহিলার মধ্যে স্তনক্যান্সারে আক্রান্তের হার প্রায় ২২.৫ জন । ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী বাংলাদেশী মহিলাদের মধ্যে স্তনক্যান্সারের সর্বাধিক প্রাদুর্ভাব জানা গেছে যা প্রতি ১০০,০০০ এর মধ্যে প্রায় ১৯.৩ জন।
ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে কথা বলা অথবা কাজ করার প্রধান প্রতিবন্ধকতা:
সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে বাংলাদেশের নারীরা যেখানে প্রকাশ্যে স্তন শব্দটি উচ্চারণ পর্যন্ত করতে চান না, সেখানে শরীরে প্রাথমিক কোন লক্ষণ দেখা গেলেও তারা গোপন রাখেন সেসব, যে কারণে বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন একেবারে শেষ পর্যায়ে। এক গবেষণায় দেখা যায়, দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে স্তনপরীক্ষা করানোর প্রবণতা কম। যার ফলে, ক্যান্সার যখন ধরা পড়ে, ততদিনে তা ছড়িয়ে পড়েছে। সে কারণে শ্বেতাঙ্গ নারীদের তুলনায় এশীয় নারীদের স্তনক্যান্সারে বাঁচার হার কম হয়। আমাদের সমাজে এখনও স্তন নিয়ে কথা বলায় চারপাশের অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে। স্তনপরীক্ষা করানোকেও অনেকে ভালো চোখে দেখেন না । অনেকের মধ্যে সামাজিক ভুল বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, পাপ আর অতীতের কৃতকর্মের ফল হচ্ছে ক্যান্সার। এইসব কারণে আমাদের দেশে স্তনকান্সার প্রতিরোধ ও প্রতিকারে অনেক বেশি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে । সর্বোপরি সচেতনা গড়ে না তুললে ভবিষ্যতে আরও জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে ।
ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে ইয়ুথ ক্লাব অব বাংলাদেশের ভূমিকা:
ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রাথমিকভাবে সঠিক জীবনধারা বজায় রাখা প্রয়োজন এবং প্রাথমিক সনাক্তকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ইয়ুথ ক্লাব অব বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধের সচেতনতা বাড়াতে এবং স্বাস্থ্যকর আচরণ প্রচার করতে সহায়তা বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কর্ম সম্পাদন করে থাকে। যেমন:
➤ সচেতনতামূলক প্রচারণা: ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকির কারণ, প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে ক্লাবের সদস্য এবং জাতিকে শিক্ষিত করার জন্য ইভেন্ট, কর্মশালা এবং সেমিনার সংগঠিত করে থাকে।
➤ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি: ইয়ুথ ক্লাব অব বাংলাদেশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহন করে থাকে। যেমন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্বদের ভিডিও বার্তার মাধ্যমে প্রচারণা এবং এর পাশাপাশি ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সচেতনতা বৃদ্ধি করে থাকে।
➤ নিয়মিত চেকআপ: প্রাথমিক সনাক্তকরণের গুরুত্ব সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে নিয়মিত ব্রেস্ট স্ব-পরীক্ষা এবং ম্যামোগ্রামকে উৎসাহিত করে থাকে।
➤ জীবন পরিচালনা করতে উদ্বুদ্ধকরন: নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্য গ্রহন এবং নিকটিন সেবন বন্ধ করার মতো স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলি প্রচার করে থাকে যা ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ ক্যাম্পেইন আয়োজন: এ আয়োজনের মাধ্যমে সকলকে ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্পর্কে জ্ঞান দিয়ে এবং প্রাথমিক স্ক্রিনিং করে ব্রেস্ট ক্যান্সার সনাক্তকরণ এ ভূমিকা পালন করে থাকে।
➤ মানসিক সমর্থন: স্তনক্যান্সারে আক্রান্তদের জন্য একটি সহায়ক নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্তদের মনোবল বৃদ্ধি করে, মানসিক সাপোর্ট দেয়ার মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীকে ব্রেস্ট ক্যান্সার মোকাবিলা করার মানসিকতা দৃঢ় করতে সহায়তা করে।
➤ অভিজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী সচেতনতা প্রচারণা: শিক্ষামূলক বা সচেতনতা মূলক প্রোগ্রাম সমূহ আয়োজনের মধ্যদিয়ে ইয়ুথ ক্লাব অব বাংলাদেশ সর্বদাই এই চিকিৎসা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অভিজ্ঞদের পরামর্শ সকলের কাছে পৌঁছে দেয়।
সর্বোপরি আমরা বিশ্বাস করি, সকলের সামগ্রিক প্রয়াস ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই পারে এই ঘাতক ব্যাধি থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করতে। আসুন-
সচেতন হই, সচেতন করি
ব্রেস্ট ক্যান্সার মুক্ত বিশ্বগড়ি
জন সচেতনতায়
ইয়ুথ ক্লাব অব বাংলাদেশ -ঢাকা বিভাগ।
তথ্য উপাত্ত সংগ্রহেঃ
সাদিয়াতুল জান্নাত, দাউদ আহমেদ সাদ, তানভীর হোসাইন তায়েফ, নুসরাত মিম, নওশিন নাওয়ার, রাহিমা নিশি, ফারিয়া আমরিন লাবনি, জয় মন্ডল।
Leave a Comment